মুকুটহীন সম্রাট তাজউদ্দীন
৭১ এ অস্থায়ী সরকার গঠন করার পর ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে যাবেন তিনি। ভারতের সীমান্তে পৌঁছালেন অথচ ভারতে ঢুকেননি। একজন বলে উঠলো “আপনি যাবেন না?”
তিনি দৃঢ় গলায় বললেন আমার দেশ স্বাধীন। আর স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে আমি বিনা প্রটোকল আর তাঁদের আমন্ত্রণ ছাড়া আমি তাঁদের দেশে যেতে পারিনা। এটি আমার দেশের জন্য প্রচণ্ড অসম্মানজনক। আমাকে তো ভারত আমন্ত্রণ জানায়নি। পরবর্তীতে যদিও ভারত সরকার তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে ভারতে নেয়। এমনই ছিলো তাঁর আত্মসম্মান বোধ।
বলে রাখা ভালো,তিনিই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোরআন হাফেজ প্রধান মন্ত্রী।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এক ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন-"মুছে যাক আমার নাম, তবু থাকুক বাংলাদেশ।"
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এক ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন-"মুছে যাক আমার নাম, তবু থাকুক বাংলাদেশ।"
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকালে বাংলাদেশের অন্যরা যখন ভারতীয় সময়ে চলতেন সেখানে তাঁর ঘড়ি চলতো
বাংলাদেশী সময়ে তথা ভারতীয় সময় থেকে ৩০ মিনিট এগিয়ে।
যেদিন তাঁর সঙ্গে প্রথম ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ভারতে দেখা হলো, ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যের কথা বলে বসলেন। এবং যেকোন মুহূর্তে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করতে প্রস্তুত বললেন । তাজউদ্দীন আহমদ বিনয়ের সঙ্গে বলে উঠলেন “এটা তো আমাদের যুদ্ধ। আমাদেরই করতে দিন!”
কলকাতার থিয়েটার রোডে একটি দুই তলা বাড়ি ভাড়া নেয়া হলো মুজিব নগর সরকারের পক্ষ থেকে মে মাসে। বাড়িটির দু তলার এক দিকের ছোট একটি স্যাঁতস্যাঁতে কামরায় থাকতেন তাজউদ্দিন আহমদ, বাকিটা অফিসের জন্য ছেড়ে দিলেন। বাড়ির বাড়িওয়ালা যেদিন জানলো একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাড়ির এই ময়লা কামরায় থাকেন তখন তিনি বলে উঠলেন, “তোমরা পারোও! প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই কামরায়! তোমরা স্বাধীন না হলে আর কে স্বাধীন হবে!”
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিক তখন।
একদিন তাঁর বাড়িতে দুই ধরনের রান্নার আয়োজন করা হলো। মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর জন্য এক ধরনের রান্না, আর সাধারন বাকিদের জন্য আরেক ধরনের রান্না। মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীদের রান্নায় বেশ আয়োজনের ভাব। তাজউদ্দীন আহমদ খেতে বসেই খাবারের আয়োজন দেখে গর্জে উঠে সহকারীকে ডাকলেন। সহকারী হাজির হতেই বলে উঠলেন এগুলো কেন? সাধারণ খাবার কই?
সহকারী বলে উঠলো এটা আপনার জন্যই স্পেশাল রান্না হয়েছে। সাধারণ খাবার কেবল ডাল, ছোট মাছ আর আলুর তরকারী।তিনি এবার চেঁচিয়ে উঠে বললেন, "দেশের মানুষ না খেয়ে আছে আর আমি এখানে পোলাও কোর্মা খাবো?"
ড. আনিসুজ্জামান তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, একদিন আনিসুজ্জামান তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় গেলেন। দেখলেন তাঁর চোখ লাল, দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। তিনি বলে উঠলেন স্যার আপনার শরীর খারাপ নাকি?
তাজউদ্দিন আহমদ বলে উঠলেন " গতকাল রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর, হঠাৎ ঝড়ে আমার ঘরের জানালার একটা অংশ খুলে গেল, তখন হঠাৎ মনে হলো, এই ঝড়ে আমার ছেলেরা না খেয়ে, না ঘুমিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করছে, আর আমি এখানে ঘুমাচ্ছি! আর সারারাত ঘুমাতে পারিনি!
মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি ঘটনা,একবার এক পিয়ন অফিসে নেই।তাঁর আরেক কর্মচারী অফিসে এসে, তাঁকে না পেয়ে সেই পিয়নের বাসায় গেলো। ঢুকেই তো ভিমরি খাওয়ার অবস্থা জ্বরে আক্রান্ত পিয়নের মাথায় বদনা দিয়ে পানি ঢালছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ।
বঙ্গবন্ধুর শক্তির অন্যতম উৎস ছিলেন তিনি। জুলফিকার আলী ভুট্টো একবার বলেছিলেন "আলোচনা বৈঠকে মুজিবকে আমি ভয় পাই না । ইমোশনালি কায়দায় মুজিবকে কাবু করা যায় , কিন্তু তাঁর পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে নটোরিয়াস লোকটি বসে থাকে তাঁকে কাবু করা শক্ত।"
১৯৭২ সাল, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার সাথে মিটিং এ বসেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। প্রাথমিক আলোচনার পর বিস্তারিত আলোচনার জন্য ম্যাকনামারা, তাজউদ্দীন আহমদ এবং সিরাজুদ্দিন যখন বসলেন, তখন ম্যাকনামারা জানতে চাইলেন বাংলাদেশের জন্য কোথায় কী ধরনের সাহায্য দরকার।
তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, 'আমাদের যা দরকার তা আপনি দিতে পারবেন কি-না আমার সন্দেহ আছে। ম্যাকনামারা বললেন, 'মিস্টার মিনিস্টার, আপনি বলুন, আমরা চেষ্টা করব দিতে।' তখন তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, 'মিস্টার ম্যাকনামারা, আমার গরু এবং দড়ি দরকার। যুদ্ধের সময় গরু সব হারিয়ে গেছে। এখানে-ওখানে চলে গেছে, মরে গেছে। পাকিস্তান যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, চাষিরা এদিক-সেদিক পালিয়ে গেছে, তখন গরু হারিয়ে গেছে।এখন যুদ্ধ শেষ, চাষি ফিরেছে কিন্তু গরু নাই, তাই চাষ করবে কীভাবে? কাজেই আমাদের অগ্রাধিকার চাহিদা হলো গরু। ম্যাকনামারার চোখ-মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, 'আর আমাদের সমস্ত দড়ি তো পাকিস্তানিরা নষ্ট করে ফেলেছে, এখন গরু পেলে গরু বাঁধতে দড়ি প্রয়োজন। গরু এবং দড়ি প্রয়োজন খুব তাড়াতাড়ি, না হলে সামনে জমিতে চাষ হবে না।'অস্বস্তিকর এই মিটিং শেষে যখন তাজউদ্দীন আহমদ কে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কেন এরকম করলেন। উনি বললেন, 'কেন, গরু ছাড়া কি চাষ হয়? মহা চটেছিলেন। বললেন, 'এই লোকটি তো আমেরিকার ডিফেন্স সেক্রেটারি ছিলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে আমেরিকা। আমাদেরকে স্যাবোটাজ করেছে। শেষ পর্যন্ত সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছে আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতে। আর তার কাছে সাহায্য চাবো আমি? এমনই আত্মসম্মান বোধ ছিলো তাঁর।
বঙ্গবন্ধু সরকার তখন বাকশাল করেছিলো তিনিই সর্বপ্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন। বাকশাল গঠনের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের গুরুতর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিলো। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় তাজউদ্দীন আহমদ হতাশ হয়েছিলেন। এসব ঘটনা বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি করেছিলো।বাকশাল গঠনের পর তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘যেভাবে দেশ চলছে তাতে আপনিও থাকবেন না, আমরাও না। দেশ চলে যাবে আলবদর-রাজকারদের হাতে"।সাধারণ ক্ষমা, বাকশাল এবং জাসদ গঠিত হওয়ার পর তাজউদ্দীন কিছু একটা আশঙ্কা করছিলেন। তাঁর ব্যাপারে শেখ মুজিবের ভুল যখন ভাঙলো না, তখন তিনি তাঁর এক হিতাকাঙ্ক্ষীকে বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই আমি যদি মারা যেতাম, তাহলে সেটাই বরঞ্চ ভালো হতো
তিনি ১৯৭৪ সালে বিভিন্ন সময় তাঁর স্ত্রীকে বলেছেন, ‘তুমি বিধবা হতে চলেছ। মুজিব ভাই বাঁচবেন না, আমরাও কেউ বাঁচব না। দেশ চলে যাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে।
দেশের জন্য এই কিংবদন্তী প্রবাদপ্রতিম মানুষটির ত্যাগ কতোখানি তা অবর্ণনীয়। ইতিহাসে বাংলাদেশ যতোদিন থাকবে, বাংলাদেশের পরিচয় যতোদিন থাকবে এ মহান নেতার নাম।
তিনি ১৯৭৪ সালে বিভিন্ন সময় তাঁর স্ত্রীকে বলেছেন, ‘তুমি বিধবা হতে চলেছ। মুজিব ভাই বাঁচবেন না, আমরাও কেউ বাঁচব না। দেশ চলে যাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে।
দেশের জন্য এই কিংবদন্তী প্রবাদপ্রতিম মানুষটির ত্যাগ কতোখানি তা অবর্ণনীয়। ইতিহাসে বাংলাদেশ যতোদিন থাকবে, বাংলাদেশের পরিচয় যতোদিন থাকবে এ মহান নেতার নাম।
Long live Bangladesh 🇧🇩❤️
আব্দুল্লাহ ইশতিয়াক
❤️
ReplyDeleteসুন্দর লেখনী
ReplyDelete